বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল
দীপ্ত টিভি ২০১৫ সালের ১৮ই নভেম্বর থেকে ধারাবাহিকটি বাংলা ভাষায় ডাবিং করে
সুলতান সুলেমান নামে সপ্তাহে ৬দিন ব্যাপী সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরু করে।
কিছু দর্শক ধারাবাহিকটির উপর তুর্কি সুলতানকে অসম্মানিত, অশ্লীল এবং ফুর্তিবাজ হিসেবে চিত্রায়িত করার অভিযোগ তোলেন। তুরস্কের সর্বোচ্চ বেতার ও টেলিভিশন পরিষদ
আরটিইউকে দাবি করে যে তারা সিরিজটির বিরুদ্ধে ৭০ হাজার অভিযোগ পেয়েছে এবং একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের গোপনীয়তাকে ভুলভাবে প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সতর্ক করে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী
রেসেপ তায়িপ এরদোয়ান ধারাবাহিকটিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের ইতিহাসকে নেতিবাচক আলোকে প্রদর্শন করার একটি প্রয়াস হিসেবে নিন্দা করেন। একে পার্টির একজন সংসদ সদস্য অকায় সারাল আরও একধাপ এগিয়ে মুহতেশেম ইউযিউয়েলের মত সিরিজে "ঐতিহাসিক ব্যক্তিগণকে ভুলভাবে তুলে ধরার" কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবার হুমকি দেন। ইসলামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদীদের কিছু ক্ষুদ্র দল স্টুডিওর সামনে প্রতিবাদ মিছিল করে কিন্তু তবুও সিরিজটি আশানুরূপ উচ্চমানের রেটিং সহ সফলভাবে চলমান থাকে।
এলিফ বাতুমান "দ্য নিউ ইয়র্কার" পত্রিকায় লেখেন:
"On the surface, 'Magnificent Century' looks like a quintessential product of the Erdoğan years. Thanks to Erdoğan's economic policies, Turkey has a thriving television industry, capable of staging elaborate period dramas, and a prosperous family-oriented middle class of observant Muslims eager to watch their own values reflected in a historical imperial setting. And, much as Erdoğan's foreign policy has promoted relations with former Ottoman lands, the show has conquered large audiences in Balkan, Caucasian, and Arab countries not known for their fond memory of Ottoman rule. Broadcast to more than two hundred million viewers in fifty-two countries, "Magnificent Century" has accomplished one of Erdoğan's main goals: Making a powerful, non-secularist, globally involved version of Turkey both plausible and appealing.... And yet Erdoğan is not a fan. In late 2012, at the opening of a provincial airport he took a moment to condemn the show's depiction of Süleyman, as well as its directors and broadcasters, hinting at severe judicial repercussions."
আসুন জেনে নিই
‘কে এই সুলতান সুলেমান’?
জন্ম ও লেখাপড়াঃ
সুলতান সুলাইমান সাগর পাড়ে ট্রাবজন নামক স্থানে ১৪৯৪ সালের ৬ নভেম্বর জনগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ছিল আয়েশা হাফসা সুলতান; যিনি চেংঘিষ খানের বংশধর ছিলেন বলে জানা যায়। সাত বছর বয়সে তিনি তোপকাপি প্রাসাদের স্কুলে বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য থিওলজী এং সামরিক বিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
সুলতান ও খলিফা পদে প্রথম সুলাইমান সুলতান সুলাইমান (প্রথম সুলাইমান) ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের দশম এবং সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী শাসনরত সুলতান, যিনি ১৫২০ সাল থেকে ১৫৬৬ সালে মৃত্যু পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন। সুলতান হওয়ার আগে তিনি বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম কাফফা, পরে সারুকান এবং এরপরে এড্রিয়ানপোল (এখনকার এড্রিন) এর গভর্নর পদে আসীন হন। তাঁর পিতা সুলতান প্রথম সেলিমের মৃত্যু পর তিনি ২৬ বছর বয়সে সুলতানের মসনদে বসেন। তার ক্ষমতারোহণের কয়েক সপ্তাহ পরে সে সময়কার ভেনেসীয় রাজ প্রতিনিধি Bartolomeo Contarini সুলতান সুলাইমান সম্মন্ধে যে উক্তিটি করে তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "He is twenty-six years of age, tall, but wiry, and of a delicate complexion. His neck is a little too long, his face thin, and his nose aquiline. He has a shade of a mustache and a small beard; nevertheless he has a pleasant mien, though his skin tends to be a light pallor. He is said to be a wise Lord, fond of study, and all men hope for good from his rule."
শাসনকালের সূচনালগ্নে সুলতান সুলাইমান মহামতি আলেক্সান্ডারের থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে অটোমান জাতিকে অপরাজেয় জাতি হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্প করেন। প্রকৃত অর্থেই তাঁর ৪৬ বছরের শাসনকাল জুড়ে পূর্ব ও পশ্চিমে সমসাময়িক মহান যোদ্ধা ও শাসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
নাম ও পদবীঃ
সুলতান সুলাইমান উসমানীয় খেলাফতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন। পাশ্চাত্যে তিনি ‘Suleiman the Magnificent’ বা ‘মহৎ সুলাইমান’ হিসেবে পরিচিত। উসমানীয় সাম্রাজ্যের নীতিমালাগুলো তৈরি করেছিলেন বলে প্রাচ্যে তাঁকে বলা হয় "Kanuni" বা ‘বিধানকর্তা’ সুলাইমান। তিনি যেসব কানুনগুলো স্থাপন করে গেছেন, সেসব কানুনগুলো উসমানীয় সাম্রাজ্যে অনেক শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম আইন সম্মন্ধে আবু হানিফার রহঃ ব্যাখ্যাই শাসকশ্রেণির স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
প্রথম সুলাইমান কেমন ছিলেন
যুবরাজ থাকালেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তখনই তাঁর সততা ও যোগ্যতার কথা সবখানে আলোচিত হত। তিনি খলিফা হওয়ার পর সারা শে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রথম সুলাইমান ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। দৈনন্দিন জীবনে তিনি ইসলামের অনুশাসনগুলো নিষ্ঠার সাথে প্রতিপালন করতেন। সকল মুসলিম নাগরিক যাতে নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন করে সেই দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। নামাজ ও রোজা পালনে শৈথিল্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। প্রথম সুলাইমান আল কুরআনের আটটি খন্ড নিজের হাতে কপি করে সুলাইমানিয়া মসজিদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি কা’বারও সংস্কার সাধন করে।
তিনি অন্যান্য ধর্মানুসারীদের প্রতিও উদার মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর শাসনকালে ধর্মীয় কোন্দলের কারণে বিপদাপন্ন হয়ে খ্রিস্টান দেশগুলো থেকে বহু প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক তাঁর পরিচালিত রাস্ট্রে এসে নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। ইতিহাসবিদ লর্ড ক্রেজি বলেন, খ্রিস্টান জগতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের অত্যাচার-অবিচারের যুগে সমসাময়িক অন্যকোন নরপতি সুলাইমানের ন্যায় প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি”।
সাহসিকতা, মহানুভবতা, ন্যাপরায়ণতা এবং বদান্যতা তার চরিত্রের ভূষণ ছিলো। তিনি নাগরিকদের করভার লাঘব করেন।
সুলাইমানিয়া মসজিদ তার অমর কীর্তি। রাট্রের সর্বত্র বহু মসজিদ, ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গোসলখানা, সেতু ইত্যাদি তৈরী করেন।
তিনি দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের বরখাস্ত করে সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি আপন জামাতাকেও গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে দেন। শাসনকাকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র খিলাফতকে ২১টি প্রদেশ এবং ২৫০টি জেলায় বিভক্ত করেন।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিস্তারকালে, সুলতান সুলাইমান ব্যাক্তিগতভাবে তাঁর সাম্রাজ্যের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, খাজনা ব্যবস্থা ও অপরাধের শাস্তি ব্যবস্থার বিষয়গুলোতে আইনপ্রণয়নসংক্রান্ত পরিবর্তন আনার আদেশ দেন। সুলতান সুলাইমান যে শুধু একজন মহান রাজা ছিলেন তা নয়, তিনি একজন মহান কবিও ছিলেন। তাঁর শাসনামলে উসমানীয় সংস্কৃতির অনেক উন্নতি হয়। সুলতান সুলাইমান উসমানীয় তুর্কি ভাষা সহ আরো পাঁচটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারতেন: আরবী ভাষা, সার্বীয় ভাষা, ফার্সি ভাষা, উর্দু ভাষা এবং চাগাতাই ভাষা (একটি বিলুপ্ত তুর্কি ভাষা)।
তাঁর সমসাময়িক প্রখ্যাত শাসক ছিলেন জার্মানির পঞ্চম চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ, রাশিয়ার জার আইভানোভিচ, পোল্যান্ডের সিজিসম্যান্ড, ইরানের শাহ ইসমাঈল এবং ভারতের সম্রাট আকবর।
দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাঃ
প্রথম দিকে উসমানী শাসকগণ নিজেদেরকে ইসলামী আইন-কানুনের প্রতিভূ মনে করতেন। ধর্মীয় আইনবিদগণ কাযী ও মুফতি নামে দুইভাগে বিভক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে বিভাগ দুটিকে প্রধান মুফতির অধীনে আনা হয়। প্রধান মুফতি শাইখুল ইসলাম নামে পরিচিত হন। ১৬ শতকের মধ্যভাগ থেকে শাইখুল ইসলামের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। তার পদমর্যাদা প্রায় উযীরে আযমের পদমমর্যাদার সমকক্ষ ছিল। কোন আইন ধর্মীয় বিধান সম্মত কিনা সেই সম্মন্ধে অভিমত দেয়াই ছিলো শাইখুল ইসলামের প্রধান কাজ। সকল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার দফতরের অধীন ছিল।
রণাংগনে প্রথম সুলাইমানঃ
প্রথম সুলাইমান ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে একজন বিশিষ্ঠ রাজা হিসেবে স্থান লাভ করেন, যার শাসনামলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বিস্তার ঘটে। সুলতান সুলাইমানের সেনাবাহিনী পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য এবং হাঙ্গেরির অনেক শহরের পতন ঘটায়। কিন্তু সুলতান সুলাইমানের সেনাবাহিনীকে ভিয়েনা শহর দখল করতে ব্যর্থ করে। প্রথম সুলাইমান পারস্যের সাফাভিদ সুলতান, প্রথম তাহমাসবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং মধ্য প্রাচ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নেন। তিনি উত্তর আফ্রিকায় আলজেরিয়া সহ বড় বড় অঞ্চলগুলো পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে দখল করে নেয়। তাঁর শাসনামলে উসমানীয় নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর পর্যন্ত তাদের আধিপত্য বজায় রাখে। তার সাফল্যের আরেকটি দিক হলো ভারত মহাদেশ থেকে তিনি পর্তুগিজদের বিতাড়িত করেন এবং ভারতের সঙ্গে উসমানীয়দের ব্যবসা সুদৃঢ় করেন। সেই সময় অটোমান সাম্রাজ্য দানিউবের কূলে বুদাপেস্ট থেকে টাইগ্রিসের কূলে বাগদাদ পর্যন্ত এবং ক্রিমিয়া থেকে নীলনদের প্রথম জলপ্রপাত বিস্তৃত ছিল। এটিই ছিল আধুনিক যুগের বৃহত্তম মুসলিম রাস্ট্র।
সময়ের পরাক্রমশালী শাসকঃ
প্রকৃত অর্থেই তিনি পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন। তাঁর রাজদরবার গোটা ইউরোপ এবং এশিয়ার অন্যতম উজ্জ্বল দরবার ছিল। ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিসকে লেখা তার একটি চিঠির বয়ান ছিল সত্যিই লক্ষ করার মত। এবার স্বয়ং ‘Suleiman the Magnificent’ এর মুখ থেকেই শুনি চলুনঃ
“আমি যিনি সুলতানদের সুলতান, রাজার রাজা, বিশ্বের বুকে সমস্ত রাজাদের মুকুটদাতা, পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া, শ্বেতসাগর এবং কৃষ্ণসাগর, রুমেলিয়া, আনাতোলিয়া, কারামানিয়া, রুম ভূখন্ড, জুলকাদ্রিয়া, দিয়ারবেকির, কুর্দিস্তান, আজেরবাইজান, পারস্য, দামাস্কাস, আলেপ্পো, কায়রো, মক্কা, মদিনা, জেরুজালেম, সারা আরব, ইয়ামান, এবং অন্যান্য দেশ যা আমার পূর্বপুরুষদের (আল্লাহ তাদের কবরকে আলোকিত করুন) বাহুবলে জয় করা ভূখন্ড এবং আমার বীরত্বের পরস্কার তাদের মহমময় আল্লাহর দান করা ভূখন্ডের সর্বময় কর্তা, আমি সুলতান সুলাইমান খান, সুলতান সেলিম খানের পুত্র, সুলতান বায়েজিদ খানের পৌত্র, তোমার উদ্দেশ্যে, ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস”।
ভিন্ন রকম তথ্যঃ
তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত The Merchant of Venice এ "Sultan Solyman" নামটি কোট করেছিলেন। (Act 2, Scene 1).
প্রথম সুলাইমানের ইন্তিকাল
১৫৬৬ সালে হাংগেরীতে পরিচালিত এক অভিযান চলাকালে আকস্মিকভাবে তিনি ইন্তিকাল করেন।
সবাইকে ধন্যবাদ।
রেফারেন্স: ১. খন্দকার মাশহুদ-উল-হাছান অনূদিত বিখ্যাত ঐতিহাসিক P. K Hitti লিখিত ‘The History of Arabs’ গ্রন্থ। ২. সংবাদপত্র।৩. আহমেদ, এ. কে. এম নাজির(২০১১). “উসমানী খিলাফতের ইতিকথা, ঢাকাঃ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার। 8. উইকিপিডিয়া।